Friday, March 17, 2017

আমি এবং আমার অতঃপর লিখেছেনঃ Pradyut Baran Chowdhury

আমি এবং আমার অতঃপর
আমি এবং আমার অতঃপর
লিখেছেনঃ Pradyut Baran Chowdhury

কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা জগত,ভার্সিটিতে উঠলাম মিশ্র অনুভূতি নিয়ে -পুরানো সব বন্ধুদের ফেলে আসা চুটিয়ে আড্ডা, পছন্দের জায়গাগুলোর মায়া কাটিয়ে চলে আসা আর সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল প্রথম ভাললাগার ব্যর্থতা,শাব্দিক অর্থে যাকে ‘ছ্যাঁক খাওয়া’ বলে।জীবনের প্রথম ছ্যাঁক খাওয়ার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ভার্সিটিতে এসে দেখি এখানে মেধার ছড়াছড়ি, মফস্বলে যেখানে হাজারে একটা পাওয়া দায়,সেখানে এত শতশত মেধাবি দেখে চক্ষুদ্বয় ছানাবড়া, সবাই এক্সপার্ট- কিছু না কিছু করছে রাত-দিন, আমি অধম গোবেচারা শুধু দূর থেকে দেখছি আর আফসোস করছি।ক্লাস শুরু হতেই ব্যাপারটা যেন নতুনমাত্রা পেল,প্রথমদিনেই এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করার ট্রাই করলাম,তবে সূচনার দিনগুলো কষ্টে কাটলেও দিন যেতে যেতে আরও কিছু বন্ধু হল যারা নিতান্ত আপন।আরেকটা বিষয় একটু দেরিতে হলেও নজর কাড়ল,চারপাশে সুন্দরী ললনা,কেউ সিনিয়র,কেউ জুনিয়র আবার কেউবা ব্যাচমেট... প্রেমিক মনটা একটার পর একটা ক্রাশ খাওয়ার ভয়ে কাউকেই কিছু বলতে পারছে না,তবে এফবি নামক রম্যবিনোদনের চ্যাটকেন্দ্রে অনেকের সাথে প্রনয় বিনিময় হচ্ছে কিন্তু আসল কাজের কিছুই হচ্ছেনা, মাথার মাঝে একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে প্রথম ছ্যাঁকার কাহিনী, রুমমেটদের ঘণ্টাব্যাপি ফোন ফাইট দেখে নিজেকে দূর্ভিক্ষের পাণি প্রার্থীর মতো অসহায় লাগছে, কিন্তু আমি তো বদ্ধ পরিকর প্রেম করবো না- বলেছি তো করবোই না!-তো করবোই না!... ইতিমধ্যে বন্ধু সকল প্রেম করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে আমাকেই বিভিন্ন সময় প্রেমবিষয়ক উপদেশ দিচ্ছে,মনে মনে বলি,‘কোন লাভ নেই, ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়...’আর এভাবেই দিন কাটতে লাগলো...

যখন আমি চতুর্থ বর্ষে তখন এক চায়ের আড্ডায় এক বন্ধু বলেই বসলো ‘জীবনের এতগুলো বসন্ত একা একাই পার করলাম, দু’কা আর হতে পারলাম না, কি করলাম এই জীবনে ??’ কথাটা অনেকটা হাসিতে উড়িয়ে দিলে তখন আরেক প্রেমবিরোধী বন্ধু বলে উঠলো,‘ধুর,তোরা সব কি যে বলছিস? জানিস না,সিঙ্গেল লাইফ রক্স, একটা মেয়েকে ভালবাসা মানে বুঝিস?? নিজের পায়ে নিজেই বেড়ি বাঁধা, শুধু শুধু নিজের স্বাধীনতাকে হস্থক্ষেপ মানা যায়,যায় না ?...’ এরকম আরো রাশভারি কথায় সে প্রমাণ করলো যে ছেলেগুলা প্রেম করে তাদের ছাগল বললে ভুল হবে তারা একএকটা মস্তবড় রামছাগল ... আড্ডায় উপস্থিত প্রায় সববন্ধুই সিঙ্গেল তাই কেউ আর পাল্টা যুক্তি না দেখিয়ে বলল ,‘দোস্ত ,একদম মনের কথা বলেছিস...’ চায়ের কাপ শেষ না হতেই চোখে পড়লো এক সহপাঠী বন্ধু জুনিয়র একটা মেয়েকে নিয়ে রিক্সা করে যাচ্ছে, আমার বন্ধুদের মনে কি হলো জানি না, কিন্তু আমার মনে হল,‘ইশ !আমার যদি কেউ এমন একজন থাকতো যার সাথে দিল খুলে কথা বলতে পারতাম, আমার দুঃখের সময়ে জড়িয়ে ধরে বলতো, কেঁদো না!আমি আছি না তোমার পাশে...’ নিজেকে সান্ত্বনা দেই এইভেবে,সবকিছুর একটা সময় থাকে ,হয়তো বা এখন সেটা না ,এর মানে এই নয় যে এখন প্রেম কখনই আসবে না আর প্রেমের প্রতি বিশ্বাস থাকলে বিধাতাও মাথা ঝুঁকে যায় তখন সময় কি! প্রেম আসবেই। তবে ,যা নিজের খুশিতে না হয় তা অন্যেরে খুশি করতে পারে না, হৃদয়ের ইচ্ছা মনের মাঝে লুকিয়ে রাখলেও একসময় তা প্রকাশ পাবে ,হতো তা জানান দিয়ে হয়তো নিরালায় নিশ্চুপে ভালোবাসা এবং আবেগের রঙ মখিয়ে।
এরপর,কয়েকমাস হল প্রবাসে পড়াশুনা করতে এলাম, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বাইরে উচ্চশিক্ষা করবো,কিন্তু কথায় আছে না -স্বপ্ন ঘুমের মধ্যেই সুন্দর, স্বপ্ন যখন বাস্তবে আসে তখন সেটা অসুন্দরের পর্যায়ে পড়ে। কথাগুলো বলছি একারনেই,এখানে আসার পর একদিনও মন খুলে কথা বলা হয়নি কারো সাথে, আর কিভাবেই হবে!-আমার জানা মতে,আশেপাশের ক্যাম্পাসে বাঙালি বলতে গেলে নেই... চাপা কষ্টটা অনেকটা বুকে রেখেই প্রতিদিন ক্লাস করি, আজও করে ক্যাম্পাস এর মাঠে বসে আছি, মনটা খানিকটা বিষণ্ণ,তাই কিছুই ভালো লাগছে না আর মনটা কিছুটা ভালো করার আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে গান করছি -বাংলা গান, আশে পাশের ছেলে-মেয়েরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে আর আমি অনেকটা কাউকে তোয়াক্কা না করেই বেসুরে গেয়ে চলেছি...

হটাৎ করে পিছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো তোমার গলা তো অনেক সুন্দর ,বাংলা শব্দ শুনে আমি বেশ অনেকটাই চমকে উঠলাম, পিছনে ফিরে দেখি শ্যামলা বর্ণের একটা মেয়ে হাসি হাসি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে,উল্লাসিত কণ্ঠে আমি বললাম,‘বাঙালি!!’ মেয়ে মাথা নেড়ে বলল,‘হ্যাঁ,তোমাকে ক্যাম্পাসে দেখেছি দুদিন,কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু হয়ে ওঠেনি, আমি এইখানেই পড়ি...’আমি পুরাই অবাক হয়ে গেলাম,একজন বাঙালীর সাথে কথা বলার জন্য আমার মন ছটফট করে যাচ্ছে গত তিন মাস ধরে আর এই মেয়ে কিনা এই ভার্সিটিতেই পড়ে আর আমি তা জানতামই না,নিজেকেই গালি দিতে মনে চাইছে...দুজন অপরিচিত বাঙালি একে অপরের সাথে বহুদিনের পরিচিত বন্ধুর মতো মন খুলে অনেকক্ষণ কথা বললাম আর মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল,আলাপে চলে আসল নিজের গল্প,পরিবারের গল্প,ওইখানকার গল্প,কিছু আজগুবি গল্প ... আর হটাৎই সময়টা দেখে মেয়েটি বলে উঠলো,‘আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে এখন উঠতে হবে’। আমি বাই দিয়ে বললাম,‘আমারও ক্লাস আছে’ মেয়েটি বলল পরে কথা হবে, হাতে শিট নিয়ে মেয়েটি একটু এগুতে শুরু করলো, আমি ভাবলাম আবার কখন দেখা হতে পারে জিজ্ঞেস করি, ওকে ডাকতে যাবো, তখন মনে পড়ল ওর নামটাই তো জানা হয়নি,ও কিছুটা দূরে চলে গেছে হাঁটতে হাঁটতে, আমি চেচিয়ে বললাম,‘তোমার নামটা তো বললে না???’পিছনে ফিরেই বলল,‘আমি!!! আমি অদিতি...’আমি আবার চিৎকার করে বললাম,‘আমি শুভ্র !আমরা কি কাল দেখা করতে পারি???’অদিতি ইশারায় এইখানে বলে মুচকি হাসি দিয়ে হেঁটে চলে গেলো...
পরদিন বিকেলে আমাদের আবার দেখা হলো,মন খুলে আলাপ চলল, একে অপরকে আরেকটু ভালোভাবে চেনা হল,দিনে দিনে কিভাবে জানি,আড্ডার পরিসরের সাথে পাল্লা দিয়ে সাক্ষাতের পরিমাণও বাড়তে লাগলো... দিনগুলো ভালই কাটতে লাগলো দুজনের ভালো-মন্দ লাগাগুলো শেয়ার করে... ওইখানে আমাদের দুজনের প্রিয় একটা নদী আছে, নদীর পাড়ে বসেই আমরা জীবনের টুকিটাকি বিষয়গুলো ভাগাভাগি করতাম...

মাঝে একবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলাম -ভয়ানক জ্বর,কোথাও যাবার যো নেই, ডাক্তার দেখাবো তার পয়সাও টাও ছিল না... অগত্যা বিছানায় পড়ে ভোগ ছিলাম,তিনদিন হচ্ছে ক্লাস করতে পারছি না।একদিন দরজায় নক শোনে কোন মতে উঠে দরজা খুলে দেখি-অদিতি দাঁড়িয়ে,আমি বললাম,‘ঠিকানা পেলে কোথায়?’ ‘ভার্সিটি থেকে নিয়েছে !!!!এতই দূরের যে একবার একটা ফোন করা যেত না’,অভিমানী সুরে বলল অদিতি। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বললাম,‘ভিতরে এসো। তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি,তাছাড়া এখন ঠিক আছি...’আমার মাথায় কাছে হাত নিয়ে রাগান্বিত সুরে বলল,‘সেরেছে অনেক জ্বর!কত দুর্বল হয়ে পড়েছে।’আমি কিছু বলব তার আগেই বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,‘আমি এসে গেছি সো নো টেনশন, দুই দিনের মাঝেই জ্বর সারিয়ে দেবে...’পরের দুইটা দিন অদিতি অনেক পরিশ্রম করলো আমাকে সত্যি সারিয়েও তুলল...

সমস্যা বাঁধল আরো কিছুদিন পর... আমার সেমিস্টার ক্লাস চলছিলো আর ওর ভ্যাকেশন শুরু হল, ওর ক্লাসমেটরা ঠিক করলো ক্যাম্পিং এ যাবে, আমি ও উৎসাহ দিলাম যাবার জন্য, ও চলে গেল বন্ধুদের সাথে, এদিকে ক্যাম্পাসে একা হয়ে গেলাম আমি, দিন তো আর কাটতেই চায় না অদিতিকে ছাড়া, দুজনের গল্প, নদীর পাশ দিয়ে হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়ানো সব কিছুই মিস করতে লাগলাম... অন্যরকম একটা শূন্যতা মনে ফিল করতে লাগলাম,দিন যত যায় শূন্যতা তত বাড়তেই থাকলো,আমি বুঝতে পারলাম অদিতির জন্যে মনে একটা বিশেষ জায়গা তৈরি হয়েছে... মাথার ভিতর তখন শত চিন্তা ভর করলো,অদিতি আমাকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করে কিনা,আমিই কি ভুল কিছু ভাবছি কিনা,অদিতিকে কিভাবে বলবো,যদি সে মেনে না নেয় তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের কি হবে? এরকম হাজারটা প্রশ্ন... সমাধান একটাই ছিল অদিতিকে সবকিছু খুলে বলা...সে ম্যাচিউর,সে খারাপ ভাবে নিবে না,যে কাউকেই যে কারো ভালো লাগতেই পারে,তাই না !

প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা বার বার মনে শঙ্কা প্রাচীর সৃষ্টি করছিল, ভাষাগুলোকে নিরেট করে দিচ্ছিলো... অদিতি ক্যাম্পিং থেকে ফিরে যেদিন ক্লাস এ আসলো ঐদিন শত চেষ্টা করেও মুখ খুলতে পারিনি, বরঞ্চ অস্বস্তি অনুভব করছিলাম কথা বলতে গিয়ে, আনমনা হয়ে পড়ছিলাম একটু পরপর,অদিতি একবার জিজ্ঞেসও করলো,আমার কিছু হয়েছে কিনা-আমি এড়িয়ে গেলাম... দিনগুলো আরো অস্বস্তিকর হতে লাগলো,সিদ্ধান্ত নিলাম এই বৈশাখে বলে ফেলব সব মনের কথা যদিও এখানে কিছু বাঙ্গালি বৈশাখ পালনের চেষ্টা করে ,...আজ ২৭ এপ্রিল-বাঙ্গালি ক্যালেন্ডার অনুসারে বৈশাখের প্রথমদিন,অদিতির দেখা করার কথা ছিল সকালে, এখনও আসেনি, আকাশটাও মেঘ করছে এই বুঝি বৃষ্টি নামবে,এই মৌসুমটাতে এমনেও এখানে একটু বেশিই বৃষ্টি হয়।আমি ঘাসের উপর বসে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখছি... হটাৎ অদিতি এসে পাশে বসলো, ওর পড়নে নীল শাড়ি, লাল টিপ... আমি বললাম,‘বৈশাখে কেউ নীল পড়ে নাকি, সবাই তো সাদা লাল পড়ে...’ ও মৃদু হাসিতে বলল,‘তুমি একবার বলেছিলে নীলে আমাকে সুন্দর দেখায় তাই পড়েছি...আর তুমি না বলেছিলে,আমাকে কি দিবে আজকে!! দাও ?’ আমি বললাম,‘চল, নদীর পাড়টায় যাই।’দুজনে হাঁটছি ,ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল অনেকটা বার্তা না দিয়েই,অদিতি একটু দ্রুত হাঁটতে লাগলে আমি ওকে বললাম,‘চল! বৃষ্টিতে ভিজি...’ও মৃদু হাসলো,তারপর দুজনেই বৃষ্টিতে হাঁটতে লাগলাম,ও আবার বলল,‘কই দিবে না,কি দিবে! দাও??’ আমি পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে ওর হাতে দিলাম, কিছু বলতে যাবো তার আগেই চিঠি পানিতে ভিজে ছিঁড়ে একাকার,আমি কি করবো না বুঝে উল্টো দিকে তাকিয়ে রইলাম, এক সময় অনুভব করলাম আমার হাতটা ধরেছে অদিতি,আমার বুকের মাঝে এক লক্ষ প্রজাপতি উড়ে গেলো।

ওর চোখে চোখ পড়তে দেখি বৃষ্টিতে গাল বেয়ে কাজল জলের স্রোত বইছে,চোখের নোনা জল বৃষ্টির পানিতে বাঁধ সাচ্ছে,আমি অপলক নয়নে ওর দিকে তাকিয়েই বলে দিলাম জীবনের সবচেয়ে দামি কিন্তু কাউকে না গোপনীয় কথা,“আজ পর্যন্ত অনেক মেয়েকেই ভাল লেগেছে কিন্তু কাউকেই মন দিতে পারিনি,কেননা তোমার মতো কোন মেয়েই পায়নি।তোমার সারাক্ষণ হাসিমাখা মুখ,ঠুঁটের ওই শুভ্র কাঁপন ,আমায় আনমনা করে দেয়,চোরা হাসিতে পাগল আমি। তোমার ওই আড়চোখের চাহনি আমায় বধ্য উন্মাদ করে দেয়,নিজের মাঝে নিজেকে অচেনা। আমার আত্মার প্রতিটি স্পন্দনের সাথে তুমি মিশে গেছো,তোমাকে ছাড়া এ জীবন অর্থহীন খা খা মরুভূমি।এই চেনা অলি-গলি,ধুলোবালি, বাতাসের মাঝে তোমার শরীরের ঘ্রাণ মিশে আছে আর তা আমায় মাতিয়ে দেয়। বুঝিনি এতোটুকু তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি স্বপ্নের ঘোরে......”

No comments:

Post a Comment