Friday, March 17, 2017

মেঘবৃষ্টি লিখেছেনঃ- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

ღমেঘবৃষ্টিღ
ღভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিশেষ গল্প-০১ღ
মেঘবৃষ্টি
লিখেছেনঃ- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

জানলার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল মেঘ। কি যেন ভাবছিল । 'জানলাটা লাগিয়ে দাও, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে' - হঠাত্‍ মায়ের কথায় চমকে উঠল সে । জানলা দিয়ে আবার তাকাল । এই মধ্য দুপুরেও অন্ধকারহয়ে আছে চারদিক । এমন দিন কখনই ভাল লাগত না তার । কেমন যেন একটা মন খারাপ করা পরিবেশ । এখন অবশ্য তার কোন রকমই লাগেনা । রোদ , বৃষ্টি কোন কিছুই তার মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না । সবসময় একই রকম লাগে । জানলার কাচঁটা টেনে লাগিয়ে দেয় । তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় । এই বারান্দাটা তার খুব প্রিয় । অনেক আনন্দ , অনেক কষ্ট , অনেক কান্নার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বারান্দাটার সাথে । বারান্দাটা তার ঘরের সাথে লাগানো । বারান্দায় আসলেই অনেক কথা মনে পড়ে যায় তার । সন্ধ্যায় বা রাতে লোডশেডিং হলে বারান্দায় শুয়ে আকাশের তারাগুলো দেখতে খুব ভাল লাগত তার । আর মন খারাপ হলেই বারান্দায় এসেবসে থাকত । কত দিন মধ্যরাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে কেঁদেছে সে তার কোন হিসাব নেই । এখন আর সে এ বারান্দায় সচরাচর আসে না । বারান্দার সাথে জড়িয়েথাকা দুঃখগুলো মনে করতে চায়না বলেই হয়ত আসে না ।
"মেঘ, তোমার ফোন এসেছে" - মায়ের কথা শুনে ঘরে যায় সে । অনেক দিন হয়ে গেছে মোবাইল ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছে । ও কাউকে ফোন করে না । কেউ যদি করে তাহলে ওর বাসার নাম্বারে করে । বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ প্রায় হয় না বললেই চলে ।বন্ধু বলতে স্কুল কলেজের বন্ধুরা । ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর কারো সাথে বন্ধুত্ব করেনি সে । একা একা ভার্সিটিতে যায় , ক্লাস করে , তারপর চলে আসে । কারো সাথে তেমন কথা বলে না । অথচ একটা সময় ছিল যখন একদিন বান্ধবীদের সাথে দেখা না হলে বা বাসা থেকে বেরুতে না পারলে হাঁপিয়ে উঠত সে । আর সারাদিন মোবাইলে কথা তো চলতই । মোবাইলে কথা বলার জন্য মার কাছে কম বকা খায়নি সে ।
মোবাইলটা নিয়ে কানে ধরে সে-
-হ্যালো কে ?
-হ্যালো মেঘ , আমি রূপা । কেমন আছিস তুই ?
-ও , ভাল । তুই ?
-আছি কোনরকম । আমার কথা আর বলিস না । খোঁজ খবর তো নিস না । ঢাকায় থাকা যে কিকষ্টের তা আর কি বলব ! মাঝে মাঝে ইচ্ছেহয় পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সিলেট চলে আসি । আগের দিনগুলা খুব মিস করি রে । তুইও তো একা হয়ে গেলি । আমাদের কথা কি মনে পড়ে না ?
-হুম ।
-আচ্ছা যাই হোক । শোন , আজকে বিকেলে বের হতে পারবি ? ছুটিতে সবাই এসেছে । সেই কবে সবাই একসাথে হয়েছিলাম । আজ বিকেলে সবাই একসাথে ঘুরব ।
-নারে , আমি আসতে পারব না । শরীরটা বেশি ভাল না ।
-কি হয়েছে ?
-তেমন কিছু না । মাথা ব্যথা ।
-মাথা ব্যথা কমে যাবে । তুই চলে আসিস ।তুই তো এমনভাবে কথা বলতি না ! আগে তো আমরা না চাইলেও জোর করে ঘুরতে বের হতি। ফুচকা না খেলে তো পেটের ভাত হজম হত না । আর এখন বাসা থেকে বের হতে চাইছিস না !
-তোরা যা । আমি আরেক দিন আসব ।
লাইনটা কেটে দিল মেঘ ।
সত্যিই তো , সে তো আগে এরকম ছিল না । আগের মেঘের সাথে এখনকার মেঘের কোন মিলই নেই । যেই মেয়ে কথায় কথায় হাসত , হাসি ছাড়া থাকতে পারত না , সেই মেয়ে এখন হাসতে ভুলে গেছে । শেষ কবে প্রাণ খুলে হেসেছিল তাও মনে করতে পারে না । মাঝে মাঝে ওর মনে হয় জীবন তাকে অনেক কিছু দিয়েছে । কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয় আসলে জীবন তাকে কিছুই দেয়নি । শুধু তার সাথে সব কিছু দিয়ে কেড়ে নেয়ার একটা খেলা খেলে গেছে ।
ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার বাধ্য মেয়ে ছিল মেঘ । পড়াশুনাতেও ভাল ছিল । সবার চোখের মণি ছিল সে । গার্লস স্কুলে পড়ার কারণে কোন ছেলে বন্ধু ছিল না । কলেজে উঠার পর কোচিং এ কিছু ছেলের সাথে পরিচয় হয় । ওরা একই কলেজে পরে । ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয় । শুধু মেঘ একানা , রূপা , মনীষা , পায়েল মানে যাদের সাথে মেঘ সবসময় থাকত সবার সাথেই ওদের ভাল একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ।
সবার আগে বন্ধুত্ব হওয়ার জন্যই হোক কিংবা অন্য কারণেই হোক , রিফাত এর সাথেমেঘের বন্ধুত্বটা ছিল একটু বেশি । ওর সাথে মোবাইলে কথাও হত বেশি ।
ভিন্ন ধর্ম তাদের বন্ধুত্বে কখনও প্রভাব ফেলে নি । মেঘ তার সব কথা শেয়ার করত রিফাত এর সাথে । রিফাত এর কেয়ারও করত খুব । কিন্তু সে কখনও ভাবেনি যে এই নিষ্পাপ বন্ধুত্বতা , বন্ধুর ভাল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা,বন্ধুকে অনুপ্রেরণা দেওয়া এ সবকিছুর ফলাফল কখনও খারাপ হবে ।
সবকিছু ভালই চলছিল । সেদিন থেকে সবকিছু ঝাপসা হতে শুরু করল যেদিন মেঘ জানতে পারল যে রিফাত তাকে ভালবাসে । কথাটা রিফাতই তাকে বলেছিল কেঁদে কেঁদে । খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন তার । তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি তার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছে । সেদিন কান্না ছাড়া আর কিছু বলতে পারে নি মেঘ । রিফাত তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু । কিন্তু তাই বলে..... । ওকে বন্ধু ছাড়া কখনও অন্য কিছু ভাবে নি মেঘ । ভাবতে পারবেও না কখনও ।
প্রথমে মেঘ ভেবেছিল এটা হয়ত সাময়িক ভাললাগা । হয়ত কিছুদিন পরে এমনিতেই সবঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু এ ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগে না তার । রিফাতকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে । এটা কখনও সম্ভব না । অন্য ধর্মের একটা ছেলেকে কখনই মেনে নেবে না তার পরিবার । আর সবচেয়ে বড় কথা সে কখনও রিফাতকে বন্ধুরচেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারবে না ।
এর মধ্যে আরেকটা ছেলে প্রোপোজ করে মেঘকে । নাম অভি , একই কলেজে পড়ে । মেঘ ওকে সরাসরি না করে দেয় । কিন্তু অভি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে । তাছাড়া কলেজে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকা , ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকা , বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করা ইত্যাদি তো আছেই । প্রথম প্রথম মেঘ একদম পাত্তা দিত না ।সবার কাছে শুনেছে অভি ছেলে হিসেবে ভাল । দেখতে ততটা সুন্দর নয় , তবে মেঘ ওকে এ কারণে না করেনি । বাহ্যিক সৌন্দর্যকে কখনও মেঘ গুরুত্ব দেয় নি ।
একদিন অভি মেঘকে কল করে । অনেক কথা বলে । মেঘ বুঝতে পারে যে অভি ওকে সত্যিই অনেক ভালবাসে । কিন্তু তবুও ও অভিকে না করেদেয় । বলে যে তার পক্ষে রিলেশন করা সম্ভব না ।
অনেক দিন কেটে যায় । যেদিন থেকে মেঘ জানতে পারে রিফাত ওকে ভালবাসে সেদিন থেকে সে রিফাতের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয় । আগের মত এত কথাও বলে না । এর কারণ রাগ বা অভিমান নয় , কারণ মেঘ চাইত রিফাত যেন তার প্রতি আর দুর্বল না হয় ।
আবার অন্যদিকে অভি মেঘকে ফোন করে প্রায়ই কান্নাকাটি করত । সঙ্গত কারণেই রিফাত অভিকে পছন্দ করত না । সে চাইত না মেঘ অভির ফোন রিসিভ করুক । মেঘ কোন এক অজ্ঞাত কারণে রিফাতের কথা রাখতে পারত না । অভি ফোন করলে সে রিসিভ না করে থাকতে পারত না । অভির সাথে কথা বলতে ওর ভাল লাগত । ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । কিন্তু রিফাত এটা শুনে কষ্ট পাবে বলে তাকে জানাত না ।
এই লুকোচুরি বেশি দিন চলতে পারে নি । একদিন রিফাত জেনে যায় একথা । মেঘের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে , অনেক কষ্ট পায় । মেঘকে সে বার বার জিজ্ঞেস করে যে তার বারণ করা সত্ত্বেও কেন মেঘ অভির ফোন রিসিভ করল ? মেঘ কোন উত্তর দিতে পারে না । শুধু নীরবে কাঁদে । কি উত্তর দিবে সে ? সে নিজেও তো জানে না কেন সে অভির সাথে কথা বলে ।
এ প্রশ্নের উত্তর সেদিন খুঁজে পেয়েছিল মেঘ যেদিন রিফাত তাকে কসম দিয়ে বলে যে যদি সে অভির ফোন রিসিভ করে তাহলে সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতচলে যাবে । একটা কথাও সেদিন মুখ থেকে বের হয়নি তার । শুধু চোখ থেকে অশ্রু নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছিল । সেদিনের পর সে বুঝতে পেরেছিল যে তার মনে তার অজান্তে অভি কতটা জায়গা করে নিয়েছিল । কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস । যে ভালবাসা তার হাতে এসে ধরা দিয়েছিল ,তাকে সে ধরতে পারে নি ।
প্রায় ২ বছর হয়ে গেছে মেঘ অভির সাখে কোন কথা বলে নি । সেদিন শুধু অভিকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল সে ।নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে ভাল রাখার জন্য নিজের ভালবাসাকে নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছিল সে ।
তবে এ ঘটনার পরে রিফাতের সাথেও সে ভালভাবে কথা বলতে পারত না । রিফাতকে কখনও কিছু বলে নি সে । কিন্তু রিফাতের উপর মনে মনে একটা রাগ জমে ছিল । নিজের অজান্তেই কথায় কথায় রিফাতের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলত সে ।
এইচ.এস.সি র পর রিফাত মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় । মেঘ রিফাতের সাথে যোগাযোগ মোটামুটি বন্ধ করে দেয় । কিন্তু অভির কথা একমূহুর্তের জন্যও ভুলতে পারে নি সে । অভি মেঘের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিল । শুনেছে এখন নাকিঅভির ফ্যামেলি ঢাকায় চলে গেছে ।
এসবের কোন কিছুই মেঘ কখনও কাউকে বলে নি । তার বান্ধবীদের কেউও জানে না । মন খারাপ থাকলেও কাউকে বুঝতে দিত না সে ।সবসময় হৈ হুল্লোর করে কষ্টগুলোকে ঢেকে রাখত ।
তারপর একে একে সবাই আলাদা হয়ে যায় । মেঘ পুরোপুরি একা হয়ে যায় । তখন থেকে আনন্দ জিনিসটা হরিয়ে যায় তার জীবন থেকে । নিঃসঙ্গতা আর অভির কিছু স্মৃতিআজ তার সবথেকে প্রিয় সঙ্গী । একটু একটু করে বুকে জমতে থাকা কষ্টগুলো মাঝে মাঝে ঝেরে ফেলতে ইচ্ছে করে তার । কিন্তু চোখের জলে তার বিন্দুমাত্রও কমে না ।
মধ্যরাতে নির্ঘুম চোখে মেঘ প্রায়ই ভাবে যদি সে আকাশের মেঘ হতে পারত , বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তো পৃথিবীর বুকে , তারপর মিশে যেত মাটির সাথে । খুব ইচ্ছে করে তার আকাশের মেঘ হতে , খুব ইচ্ছে করে ।
.................---¬¬¬¬---..............¬.¬.¬
এই সময়ে ২/১৪/২০১৩ ১০:০৮:০০ PM 

No comments:

Post a Comment